রাজধানীর সড়কে সেই চিরচেনা যানজট। ফুটপাত, অলিগলি থেকে অভিজাত শপিংমল ও পাঁচতারকা হোটেল- সর্বত্রই মানুষের সরব উপস্থিতি। ঈদ সামনে রেখে রাজধানীর পশুর হাটগুলোতেও উপচে পড়া ভিড়। গ্রামমুখী গাড়ির চাপে মহাসড়কে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট। কোথাও সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না। স্বাস্থ্য সুরক্ষার অংশ হিসেবে নূ্যনতম মাস্কও পরছেন না অধিকাংশ মানুষ। যেন স্বাস্থ্যবিধি না মানার উৎসব শুরু হয়েছে!
বিপরীতে দেশে করোনা শনাক্তের হার বাড়ছে। প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর তালিকা। স্বাস্থ্য বিভাগ, জাতীয় পরামর্শক কমিটি, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ- সবাই বর্তমান পরিস্থিতিকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। কেউ কেউ বলছেন, সরকারের এলোমেলো সিদ্ধান্তের কারণে প্রাণঘাতী পরিস্থিতি আমলে না নিয়ে উল্টো স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করেছে মানুষ। এতে করে সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও নাজুক হতে পারে।
গতকাল এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পরিবহন মালিকদের প্রতি হুঁশিয়ার উচ্চারণ করে বলেছেন, যাত্রী পরিবহনের শর্ত লঙ্ঘনকারী পরিবহন মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অপর এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে জনসাধারণকে সতর্ক করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, হাসপাতালে শয্যা খালি নেই। সংক্রমণের হার বেড়ে গেলে হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হবে না। সুতরাং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।
তবে মন্ত্রী ও বিশেষজ্ঞদের আহ্বান আমলে নিচ্ছে না কেউ। গত শুক্র ও শনিবার রাজধানীর মগবাজার, পল্টন, কাকরাইল, মৌচাক, পান্থপথ, কারওয়ান বাজার, নিউমার্কেটসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ফুটপাতে ভাসমান চা-সিগারেটের দোকানে ভিড়। পুরোনো চেহারায় ফিরেছে কারওয়ান বাজার। সেখানে পা ফেলাই দায়। অধিকাংশ ক্রেতা-বিক্রেতার মুখে মাস্ক নেই।
গতকাল মিরপুর ২ নম্বর গোলচত্বরে অনেক পথচারীকে মাস্ক ছাড়া চলাফেরা করতে দেখা যায়। কেউ কেউ মাস্ক পরলেও তা ঝুলিয়ে রেখেছেন থুতনিতে। ফুটপাতের দোকানিদের অধিকাংশই ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন মাস্ক ছাড়া। মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক রিকশাচালক কাছাকাছি দূরত্বে দাঁড়িয়ে মাস্ক না পরেই কথা বলছিলেন নিজেদের মধ্যে। মাস্ক কেন পরেননি, জিজ্ঞেস করলে শার্টের পকেটে একটি কাপড়ের মাস্ক দেখিয়ে আউয়াল নামে এক রিকশাচালক এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এতক্ষণ পরাই ছিলাম স্যার। এহন কথা কইতাসি দেইখা খুইলা রাখসি। মাস্ক পইরা কথা কওন যায় না।’
সেখান থেকে মিরপুর-আগারগাঁওয়ের ৬০ ফুট সড়কের দিকে গিয়েও দেখা যায় একই অবস্থা। রাস্তাঘাটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা কম, তবে মিরপুর থেকে বেতার হয়ে ফার্মগেট যাওয়া লেগুনাতে যাত্রীরা মাস্ক পরেই উঠছিলেন। গণপরিবহনগুলোতেও ছিল না স্বাস্থ্যবিধি। এক আসন ফাঁকা রেখে যাত্রী ওঠানোর নিয়ম থাকলেও দূরপাল্লার পরিবহনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।
ঈদের মাত্র দু’দিন বাকি থাকায় জনসমাগম বেড়েছে সব জায়গায়। নিউমার্কেটের দোকানগুলোতে ক্রেতার চাপ ছিল বেশি। অনেক ভাসমান কাপড় বিক্রেতা ফুটপাতেই দোকান খুলে বসায় পথচারীদের লাইন ধরে গা ঘেঁষে চলতে হয়েছে। নিউমার্কেটের আশপাশের রাস্তাগুলোতে পার্কিং করে রাখা গাড়ি ও ভাসমান ক্যানভাসারদের কারণে লোকজনের জটলা থাকায় চলাচল করা যানবাহনগুলোকে জটে পড়তে হয়েছে।
রাজধানীর পশুর হাটগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা লক্ষ্য করা গেছে। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও গ্রাম থেকে কোরবানির পশু বিক্রি করতে রাজধানীতে আগতদের মধ্যে মাস্কের ব্যবহার কম। এ ছাড়া যারা কোরবানির পশু দেখতে ও কিনতে আসছেন, তারাও ঠিকমতো মাস্ক পরছেন না। ঈদের সময় ঘনিয়ে আসায় হাটগুলোতে গতকাল ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেক হাটের প্রবেশমুখ সরু হওয়ায় এবং ক্রেতাদের চাপ বেশি থাকায় অনেককেই ধাক্কাধাক্কি করে ভেতরে ঢুকতে হয়েছে। সর্বত্রই উপচে পড়া ভিড়।
‘পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে’ :কভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ সমকালকে বলেন, বিজ্ঞানসম্মত বিষয় বিবেচনায় নিয়ে টানা আরও ১৪ দিনের লকডাউনের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু ঈদুল আজহা উদযাপন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে হয়তো সেটি সম্ভব হয়নি। তবে যেভাবে মানুষ বাড়ি যাচ্ছে, সড়ক, বিপণিবিতান, পশুর হাটে ভিড় করছে তাতে সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। কারণ, অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। মাস্ক ব্যবহার, সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই। সুতরাং সংক্রমণ বাড়বে, তা বলাই যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ সমকালকে বলেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে খোঁজ করলে প্রতিটি ঘরে হয়তো করোনা সংক্রমিত রোগী পাওয়া যাবে। এখন শুধু ঢাকা নয়, রাজশাহী, খুলনা, বরিশালসহ সারাদেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। গত বছর গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণ ততটা না ছড়ালেও এবার তার ব্যত্যয় ঘটেছে। অনেক জেলা-উপজেলায় শনাক্তের হার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এ অবস্থায় প্রয়োজন ছিল আরও কঠোর লকডাউনের। কিন্তু ঈদ উপলক্ষে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে মানুষ গ্রামে ফিরছেন। হাটে-বাজারে, বিপণিবিতান থেকে শুরু করে সর্বত্রই স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। এটি আতঙ্কের। ঈদের পরপরই সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, জীবন-জীবিকার সমন্বয় করতে গিয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। কঠোর বিধিনিষেধ অব্যাহত থাকলে হয়তো সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে আসত; কিন্তু ঈদ সামনে রেখে সেটি অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। কারণ কোরবানির পশুর কেনাবেচা, মানুষের চলাচল, অর্থনৈতিকসহ অন্যান্য বিষয় রয়েছে। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে ৯ দিনের জন্য বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু মানুষ যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে চলাচল করছে, তা উদ্বেগের।
মন্ত্রী বলেন, রোগীর চাপে হাসপাতালে শয্যা প্রায় পূর্ণ হয়ে গেছে। রোগী আরও বাড়লে হাসপাতালে জায়গা দেওয়া সম্ভব হবে না। এটি বাস্তবতা। সুতরাং সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, অত্যন্ত প্রয়োজন না হলে ঘরেই থাকুন। গ্রামে পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ করতে গিয়ে নিজেকে ও স্বজনদের ঝুঁকিতে ফেলবেন না।
সুত্রঃ সমকাল।