আগস্টের এমন সময়ে চিম্বুক পাহাড় থেকে ক্যক্রাডং পর্যন্ত বিস্তীর্ণ পাহাড়ের ঢালে ঢালে জুমের পাকা ধান কাটার উৎসবে মেতে উঠতেন জুমিয়ারা।
এবার পাহাড়ের ঢালে ঢালে উৎসবের পরিবর্তে হাহাকার বইছে। টানা খরায় জুম ক্ষেতে লাগানো ধানের অধিকাংশই প্রায় পুড়ে গেছে। যেগুলো বেঁচে আছে এখনো, বৃষ্টির অভাবে সেগুলো ফলবতী (ধানের ছড়া বের হয়নি) হয়নি এখনো।
শনিবার ২০ আগস্ট বান্দরবান জেলা সদর থেকে থানচি হয়ে তাহজিংডং পাহাড়ের পাদদেশ বাকৎলাই এলাকা ঘুরে এবং রবিবার ২১ আগস্ট বাকৎলাই (Baktlai) থেকে চিম্বুক পাহাড়ের বেশ কিছু এলাকায় গিয়ে জুমে হাসির পরিবর্তে জনাকতেক জুমিয়ার শুকনো মুখ দেখতে হয়েছে।
থানচি-রেমাক্রি সড়কের রাঙ্গিয়া পাড়ায় একটি চায়ের দোকানে দেখা হয় জুমচাষী অলসেন ত্রিপুরা (৩৮), বীর বাহাদুর ত্রিপুরা (২৬), মেননাও ম্রো (২৮), মেনথং ম্রো (২৫), চিংপ্রতি ম্রো (২৪), অংতøাং ম্রো (২৭) এবং স্মৃতি ত্রিপুরার (২৪) সাথে। সবার পেশা কিংবা জীবিকা জুমচাষ।
তরুণ জুমচাষী বীর বাহাদুর ত্রিপুরা গত কয়েক বছর ধরে সংসারের হাল ধরেছেন। বাবা-মা, নিজের স্ত্রী-সন্তান এবং ছোট ভাইকে নিয়ে ৬ সদস্যের পরিবার। বীর বাহাদুর বলেন, ৫ হাড়ি (প্রতি হাড়িতে প্রায় ১ একর জমিতে ধান লাগানো যায়) পরিমাণ পাহাড়ি জমিতে জুম চাষ করে ১৮০ হাড়ি (প্রতি হাড়িতে ১০ কেজি ধান) ধান পাওয়া গেছে। এখন ধানের মজুদ প্রায় শূন্য হয়েছে। কিন্তু এখনো জুমে ধান না আসায় চোখে অন্ধকার দেখছেন।
ধানের ফলন যদি ভালো না হয়, তাহলে কি করবেন- জানতে চাইলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বীর বাহাদুর ত্রিপুরা বলেন, “ঈশ্বর খাওয়ালে খাবো। না হলে উপোষ করে করে মরবো।”
“এ ছাড়া আর উপায় কি? বাজার থেকে চাল কিনে খাওয়ার জন্য আমাদের তো টাকা নেই।” হতাশায় তার চোখে মুখে অন্ধকার নেমে আসে।।
১৭ সদস্যের বিশাল পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়েছে আরেক তরুণ মেননাও ম্রোকে।
তিনি জানান, গত বছর ১৩ হাড়ি পাহাড়ি জমিতে জুম চাষ করে ৫৫০ হাড়ি ধান পেয়েছেন। এবারো ১২ হাড়ি পরিমাণ জমিতে জুম চাষ করেছেন। কিন্তু প্রকৃতির বিরূপ আচরণের কারণে ঘরে ১০০ হাড়ি ধান উঠবে কি না তা নিয়ে সংকায় আছেন মেননাও ম্রো।
কথা হয় অলসেন ত্রিপুরার সাথে। তিনি বলেন, “জুমে ধান না হলে এত বড় পরিবারের মুখের আহার কিভাবে যোগাবো- তা নিয়ে অস্থির আছি।”
থানচি উপজেলা উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ দাশ গুপ্ত জানান, এই উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে প্রতি বছর মোট ২৪৮৪ হেক্টর জমিতে জুম চাষ করে ৩১৬৭ পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। প্রতি হেক্টরে গড়ে দেড় মেট্টিক টন ধান উৎপাদন হয়ে থাকে। সেই হিসেবে থানচি উপজেলায় মোট ৩৮০০ মেট্রিক টনের মতো ধান উৎপাদিত হয়।
কিন্তু এ বছর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আশংকাজনক হারে কম হওয়ায় জুমখেত থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান উৎপাদন সম্ভব হবে না।
মৃত্তিকা সংরক্ষণ ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) বান্দরবান মৃত্তিকা সংরক্ষণ ও পানি বিভাজিকা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর বান্দরবান জেলায় ২৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত দরকার। কিন্তু ২৩ আগস্ট পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে ১০৫৫ মিলিমিটার।
কেন্দ্রের ইনচার্জ কৃষিবিদ মাহবুবুল ইসলাম বলেন, আগামী দিনগুলোতে বেশি পরিমাণ বৃষ্টিপাতের খুব বেশি সম্ভাবনা নেই।
এ অবস্থায় চাহিদা অনুযায়ী বৃষ্টিপাত না পেলে জুম কেন্দ্রিক খাদ্য উৎপাদন চরমভাবে বিঘ্নিত হতে পারে।