স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনরত আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)’ এবং তাদের সামরিক শাখা ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)’ বিরোধী বিভিন্ন অভিযানে বিপুল সংখ্যক গ্রেপ্তার, অসংখ্য হতাহত ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের সাফল্যকে ছাড়িয়ে গেছে বৃহস্পতিবার ভোরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রুমা জোনের অভিযান।
এমন ধারণা পোষণ করছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয়রা।
তারা মনে করেন, এই অভিযানে প্রথমবারের মত ‘কেএনএফ’ এর গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ও ‘কেএনএ’র একজন ফিল্ড কমান্ডার এবং অপর এক সশস্ত্র ক্যাডারের প্রাণ এবং ৪টি অত্যাধুনিক অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ বুলেট হারাতে হয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী এই সংগঠনটিকে।
অন্যদিকে এই অভিযানের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রুমা জোনের কমান্ডিং অফিসার (সিও) লে. কর্ণেল আলমগীর হোসেন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বলেছেন, রুমা এলাকায় ‘কেএনএ’র বিশেষ একজন কমান্ডারের অবস্থান সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হই। এবং অভিযানের পরিকল্পনা করি। পরে এ বিষয়ে বান্দরবান রিজিয়নের অনুমোদন গ্রহণ করি।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী বুধবার রাতেই রুমা জোনের সেনা সদস্যরা সম্ভাব্য এলাকাটি ঘিরে ফেলে তল্লাশী শুরু করে। এসময় মুয়ালপি ও নায়তং পাহাড়ের মধ্যবর্তী এলাকায় ‘কেএনএ’র আস্তানার কাছাকাছি পৌঁছে যায় সেনা অভিযাত্রী দল। তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে ‘কেএনএ’ সদস্যরা সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। কিন্তু সেনা সদস্যদের কৌশলী আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে বেশ কয়েকজন পালিয়ে যায়।
সূত্র জানায়, ভোর ৫টার দিকে সেনা জওয়ানরা সেখানে তল্লাশী চালিয়ে ‘কেএনএ’র ইউনিফর্ম পরা দু’টি মরদেহ এবং ৩টি অত্যাধুনিক এসএমজি, ১টি চাইনিজ রাইফেল, ৮টি ম্যাগাজিন, ৯ দশমিক ৯৬ মি:মি: বল এ্যামো ১৫৪ রাউন্ড, ৩৯ মি:মি: এ্যামো ২৩৭ রাউন্ড, ৫৪ মি: এ্যামো ৬০ রাউন্ড, ৩ সেট ইউনিফর্ম, ৮টি স্মার্ট ফোন, ৭টি বাইবেল, ওয়ারলেস সেটসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জামাদি উদ্ধার করে।
প্রথম দিকে নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত না হলেও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর সবার পরিচয় বেরিয়ে আসে।
সূত্র জানায়, ৩ জুলাই ভোরে বান্দরবানের রুমায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলা গ্রুপ ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি বা কেএনএ’র যে বন্দুক যুদ্ধ হয়- তাতে ‘কেএনএ’র মাঠ পর্যায়ের কমান্ডার ও চিফ কালেক্টর সাংমিন সাং (২৭) নিহত হয়েছে- এটা নিশ্চিত।
সংগঠনে তার নাম পুতিন। তবে মেজর নয়, তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার। নিহতের পরিচিতজন, এলাকাবাসী এবং অন্যান্য বিশ্বস্ত সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ক্যাপ্টেন পুতিনের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ২ এপ্রিল রাতে রুমায় সোনালী ব্যাংকে হামলা ও অস্ত্র লুটের অভিযান পরিচালিত হয়েছে বলেও সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, শুরুতে মূল সংগঠন ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ’ এর একজন তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন মুয়ালপি পাড়ার বাসিন্দা সাংমিন সাং। তবে তার সাহস এবং চৌকষ ভূমিকার কথা বিবেচনা করে তাকে সামরিক শাখা ‘কেএনএ’ তে দায়িত্ব দেয়া হয়।
রুমায় সফল অভিযান শেষে মিজোরামে চলে যান পুতিন। সম্প্রতি তাকে পদোন্নতি দিয়ে রুমা এলাকার ফিল্ড কমান্ডার এবং চিফ কালেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু এখানে এসে তিনি সেনা অভিযানের মুখে পড়ে নিহত হন।
জানা গেছে, রুমা থেকেই এসএসসি পাশ করেন সাংমিন সাং। ‘কেএনএফ’ এর সাথে জড়িত হবার পর তাকে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের মনিপুর রাজ্যে পাঠানো হয়। গত বছরে রুমা এবং থানচিতে ব্যাংক লুটের ঘটনার পর যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হলে তার পিতা জওথান বম পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে ভারতের মিজোরাম চলে যান। সাম্প্রতিক সময়ে পালিয়ে যাওয়া ১২৬টি বম পরিবার নিজ নিজ পাড়ায় ফিরলেও জওথান-এর পরিবারের কেউ এখনো মুয়ালপি পড়ায় ফিরেননি।
বৃহস্পতিবারের বন্দুক যুদ্ধে নিহত ‘কেএনএ’র অপর সদস্যের নাম ও পরিচয় পাওয়া গেছে।
নিহত লাল হিম সাং বম (২৫) ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি’র একজন সৈনিক। তার সাংগঠনিক নাম আহিম। রুমা উপজেলার মুন্নুয়াম পাড়ার বাসিন্দা সে।