দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালের শয্যার ওপরও চাপ বাড়ছে। কভিড-১৯ ডেডিকেটেড দুই-তৃতীয়াংশ শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, রাজশাহী-খুলনার পর ঢাকা, বরিশাল ও সিলেটে হাসপাতালের শয্যার ওপর রোগী ভর্তির চাপ বেশি। সিলেটের একশ শতাংশ আইসিইউ শয্যায় রোগী রয়েছে। রাজশাহী, ঢাকা ও খুলনা বিভাগে আইসিইউর ৮০ শতাংশের ওপরে শয্যায় রোগী ভর্তি। একই সঙ্গে রাজশাহী বিভাগে ৮৬ শতাংশের ওপরে সাধারণ শয্যায় রোগী রয়েছে। বরিশালে ৮০ শতাংশ ও ঢাকায় ৭১ শতাংশ সাধারণ শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে সাধারণ শয্যার সবচেয়ে কম ৫২ শতাংশ রোগী ভর্তি আছে। আর আইসিইউতে সবচেয়ে কম ৫৯ শতাংশ রোগী ভর্তি আছে রংপুরে।
সারাদেশে কভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালের ৬৭ শতাংশ সাধারণ শয্যায় এবং ৮০ শতাংশ আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি রয়েছে। জুলাই মাসের ১৮ দিনে শনাক্ত হয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার ৭৩১ জন রোগী। একই সঙ্গে মারা গেছে তিন হাজার ৩৯১ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার ৫৯৬ জন এবং ১৮৮ জনের ওপরে মারা গেছে। বর্তমানে দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা এক লাখ ৫৪ হাজার ৮৭ জন। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি আছে ১১ হাজার ৪৯৮ জন। অর্থাৎ মোট রোগীর সাড়ে সাত শতাংশের মতো হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। অন্যরা বাসাবাড়িতে আছে। রোগীর চাপ যে হারে বাড়ছে তাতে হাসপাতালে আক্রান্তদের সবাইকে শয্যা দেওয়া সম্ভব হবে না বলে মনে করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি সমকালকে বলেন, রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলে হাসপাতালে শয্যা দেওয়া সম্ভব হবে না। সুতরাং আক্রান্ত যাতে আর না বাড়ে সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। অর্থাৎ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
করোনার উচ্চ সংক্রমণের মধ্যেই গত ১৫ জুলাই থেকে ৯ দিনের জন্য বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। এরপরই সড়ক-মহাসড়কে সেই চিরচেনা যানজট সৃষ্টি হয়েছে। ফুটপাত, অলিগলি থেকে অভিজাত শপিংমল ও পাঁচতারকা হোটেল- সর্বত্রই মানুষের সরব উপস্থিতি। ঈদ সামনে রেখে রাজধানীর পশুর হাটগুলোতেও উপচে পড়া ভিড়। কোথাও সামাজিক দূরত্ব মানার বালাই নেই। স্বাস্থ্য সুরক্ষার অংশ হিসেবে নূ্যনতম মাস্কও ব্যবহার করছেন না অনেকেই। এ পরিস্থিতি সংক্রমণ আরও বাড়াবে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, ঈদুল আজহা সামনে রেখে সড়ক-মহাসড়কে ভিড় বেড়েছে। লঞ্চ, বাস ও ট্রেনে ভিড় করে মানুষ গ্রামে ফিরছেন। পশুর হাট ও শপিংমল সর্বত্রই ভিড়। কিন্তু কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। এতে করে সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও নাজুক হতে পারে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কার সত্যতা মিলেছে সরকারি পরিসংখ্যানেও। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে থাকা গত এক মাসে দেশে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১ জুন থেকে গতকাল রোববার এক মাস ১৮ দিনে সারাদেশে কভিড-১৯ ডেডিকেটেড সাধারণ শয্যায় রোগী ভর্তি বেড়েছে ৫০ দশমিক ১১ শতাংশ। একই সঙ্গে আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি বেড়েছে ৫০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। জুলাই মাসের ১৮ দিনে সাধারণ শয্যায় রোগী বেড়েছে ২১ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং আইসিইউতে বেড়েছে ২৫ দশমিক ০৩ শতাংশ।
ঢাকা মহানগরের ৬৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ সাধারণ শয্যা এবং ৮২ দশমিক ১১ শতাংশ আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি আছে। ঢাকা বিভাগের ৭০ দশমিক ৮৬ শতাংশ সাধারণ শয্যা এবং ৮১ দশমিক ১৯ শতাংশ আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি আছে। চট্টগ্রাম বিভাগের ৫২ দশমিক ১২ শতাংশ সাধারণ শয্যা এবং ৭৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি আছে। ময়মনসিংহ বিভাগের ৬৪ দশমিক ১৩ শতাংশ সাধারণ শয্যা এবং ৬৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি আছে। রাজশাহী বিভাগের ৮৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ সাধারণ এবং ৮৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ আইসিইউ শয্যায় রোগী আছে। রংপুর বিভাগের ৫৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ সাধারণ এবং ৫৯ দশমিক ০৯ শতাংশ আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি আছে। খুলনা বিভাগের ৬৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ সাধারণ এবং ৮০ দশমিক ৬০ শতাংশ আইসিইউ শয্যায় রোগী আছে। বরিশাল বিভাগের ৭৯ দশমিক ১৯ শতাংশ সাধারণ এবং ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি আছে। সিলেট বিভাগের ৫৩ দশমিক ৫২ শতাংশ সাধারণ এবং ১০০ শতাংশ আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি আছে।
চলতি বছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত হুহু করে শনাক্ত ও মৃত্যু বাড়ছিল। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনা সংক্রমণের পর ওই বছরের জুন-জুলাই মাসে চূড়ায় বা পিকে পৌঁছেছিল। কিন্তু চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিলের সংক্রমণ ছিল আগের বছরের প্রায় দ্বিগুণ। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে রোগী কিছুটা কমতে থাকে এবং মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত আক্রান্ত ও মৃত্যু দুই কমে আসে। কিন্তু মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে সংক্রমণ শুরু হয়। ওই সংক্রমণ ধাপে ধাপে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছে। গত ১ জুন থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত হাসপাতালে রোগী ভর্তির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১ জুন সারাদেশে কভিড-১৯ ডেডিকেটেড সাধারণ শয্যায় রোগী ভর্তির হার ছিল ১৭ দশমিক ২৮ শতাংশ এবং আইসিইউতে ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ওই দিন ঢাকার সরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় রোগী ভর্তির হার ছিল ২১ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং আইসিইউতে ৩১ দশমিক ২৮ শতাংশ। ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় রোগী ভর্তির হার ছিল ১০ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং আইসিইউতে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় রোগী ভর্তির হার ছিল ১৮ দশমিক ২৭ শতাংশ এবং আইসিইউতে ২১ দশমিক ০৯ শতাংশ। দেশের অন্যান্য জেলায় সাধারণ শয্যায় রোগী ভর্তির হার ছিল ২১ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং আইসিইউতে ৪৯ শতাংশ। এর ১০ দিনের মাথায় ১০ জুন সারাদেশে সাধারণ শয্যার রোগী ভর্তির হার বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ০৬ শতাংশে। আর আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৯৩ শতাংশে। ২০ জুন সারাদেশে রোগী ভর্তির হার দাঁড়ায় সাধারণ শয্যায় ৩২ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং আইসিইউ শয্যায় ৪১ দশমিক ৭১ শতাংশ। এর ১০ দিনের মাথায় ২৯ জুন সারাদেশে সাধারণ শয্যা ও আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৪৫ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং ৫৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। ১৯ দিনের মাথায় গতকাল রোববার ১৮ জুলাই সারাদেশে সাধারণ শয্যায় রোগী ভর্তি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং আইসিইউতে ৭৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ জুলাই মাসের ১৮ দিনে সাধারণ শয্যায় রোগী বেড়েছে ২১ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং আইসিইউতে বেড়েছে ২৫ দশমিক ০৩ শতাংশ। আর এক মাস ১৮ দিনে সাধারণ শয্যায় রোগী বেড়েছে ৫০ দশমিক ১১ শতাংশ এবং আইসিইউতে বেড়েছে ৫০ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
আরও খারাপ পরিস্থিতির শঙ্কা, চিকিৎসা সুবিধা বাড়ানোর তাগিদ বিশেষজ্ঞদের :করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে চিকিৎসা সুবিধা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাপ্রাপ্তির পূর্ব অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। সংক্রমণ বাড়তে থাকলে তখন কিছু শয্যা বাড়ানো হয়। এরপর আবার সেই উদ্যোগ থেমে যায়। প্রধানমন্ত্রী জেলা সদর হাসপাতাল পর্যন্ত আইসিইউ সুবিধা নিশ্চিত করতে বললেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি পর্যাপ্ত সাধারণ শয্যাও বাড়েনি। করোনার সংক্রমণপ্রবণ ভারতীয় ধরনে ভারত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অক্সিজেন সংকট চরমে পৌঁছেছিল। হাসপাতালে মানুষকে ঠাঁই দেওয়া যায়নি। ওই ধরনটি বাংলাদেশেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সুতরাং স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি না থাকলে মানুষকে চরম মূল্য দিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ সমকালকে বলেন, বিধিনিষেধ শিথিল করার মূল্য দিতে হতে পারে। সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। মোট রোগীর সাড়ে ৭ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ১৫ থেকে ২০ শতাংশ রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলে শয্যা দেওয়া সম্ভব হবে না। ভারতের মতো দেশও পারেনি। সেদিক থেকে বলা যায়, রোগী বাড়লে চিকিৎসা না পেয়েই হয়তো অনেকে মারা যাবেন। কারণ ইতোমধ্যে ৭৫ শতাংশের মতো শয্যা পূরণ হয়ে গেছে। রোগী বাড়তে থাকলে বাকি শয্যাও পূর্ণ হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ করা। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষ এতে কতটুকু করতে সমর্থ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ ফিল্ড হাসপাতালের ঘোষণা দেওয়ার এক সপ্তাহ পরও কোনো কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি। এর পরও তাদের প্রতি দ্রুত চিকিৎসা সুবিধা বাড়ানোর আহ্বান থাকবে। অন্যথায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
সূত্রঃ সমকাল।